২০০৫ সালের ৮ ডিসেম্বর জঙ্গি সংগঠন জামাআ’তুল মুজাহিদীন বাংলাদেশের (জেএমবি) আত্মঘাতী বোমা হামলায় রক্তাক্ত হয় নেত্রকোনার সাংস্কৃতিক অঙ্গন।
জেলা শহরের অজহর রোডে উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীর কার্যালয়ের সামনে জঙ্গিদের বর্বোরিচত হামলায় নিহত হন উদীচীর শিল্পী-সংগঠক খাজা হায়দার হোসেন ও সুদীপ্তা পাল শেলী, মোটর গ্যারেজের কর্মচারী যাদব দাস, গৃহিণী রানী আক্তার, ভিক্ষুক জয়নাল, রিকশাচালক আপ্তাব উদ্দিন, ব্যবসায়ী রইছ মিয়া এবং কাফি নামের এক আত্মঘাতী কিশোর। হামলায় আহত হন আরো অর্ধশতাধিক।
৮ ডিসেম্বর ২০০৫। সকাল ১০টা। পরদিন ৯ ডিসেম্বর নেত্রকোনা মুক্ত দিবস উপলক্ষে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মহড়ার প্রস্তুতি চলছিল উদীচী কার্যালয়ে। এমন সময় উদীচী ও পার্শ¦বর্তী শতদল সাংস্কৃতিক গোষ্ঠীর মাঝখানের খোলা জায়গায় লাল রঙের কৌটাসদৃশ একটি ‘বস্তু’ দেখতে পান স্থানীয় লোকজন। কৌটার ওপর একটি চিঠি। ঘটনা বুঝতে কারো বাকি রইলো না। কারণ ১৭ আগস্টের সিরিজ বোমা হামলার পর থেকে দেশজুড়েই তখন ‘বোমা আতঙ্ক’। খবর পেয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও দমকল কর্মীরা এসে নিষ্ক্রিয় করলেন বোমাটি। বোমার খবর পেয়ে শত শত মানুষ জড়ো হলেন অজহর রোডের উদীচী কার্যালয়ের সামনে। ছুটে এলেন উদীচীর শিল্পী, কর্মীরাও। আর সেই মোক্ষম সুযোগটিকেই কাজে লাগালো আত্মঘাতী জঙ্গিরা। শত শত মানুষের ভিড়ের মধ্যে একটি বাই-সাইকেল নিয়ে ঢুকে গেল এক আত্মঘাতী কিশোর। কিছু বুঝে ওঠার আগেই (১০টা ৪০ মিনিটের সময়) বিকট শব্দে বিস্ফোরিত হলো তার সাইকেলে বহন করা দ্বিতীয় বোমাটি। বোমার স্পি¬ন্টারের আঘাতে মুহূর্তেই ছিটকে পড়লো ৫০-৬০ জন। রক্তের বন্যা বইয়ে গেল। নিথর পড়ে রইলো আহত-নিহতরা। অজহর রোডের মানুষের কাতার গিয়ে পৌঁছল সদর হাসপাতালে। অবশ্য সেই আত্মঘাতী কিশোরের পরিচয় মিলেছিল ঘটনার অনেক পর, মামলার তদন্তের পর্যায়ে।
দুপুরের দিকে ঘটনা ভিন্ন দিকে মোড় নিতে শুরু করলো। বলাবলি হতে লাগলো হাসপাতালের বারান্দায় পড়ে থাকা একজন ‘আত্মঘাতী জঙ্গি’। তার নাম যাদব দাস। যাদবকে ‘হিন্দু জঙ্গি’ হিসেবে আবিষ্কার করে সরকারের দায়িত্বশীল সূত্র থেকে মিডিয়ার সামনে বলা হলোÑ ‘ইটস এ নিউ ডাইমেনশন ইন জঙ্গিবাদ’। তাকে হিন্দু প্রমাণ করতে বারবার ওপড়ে টেনে তোলা হলো তার নিম্নাঙ্গের কাপড়টি। সচেতন ও বিবেকবান মানুষদের মনে প্রশ্ন ওঠলোÑ ‘হিন্দু যাদব’ জঙ্গি হতে যাবে কেন? ততোক্ষণে কারো বুঝতে বাকি রইলো নাÑ ঘটনা কোনদিকে গড়াচ্ছে। অবশেষে জনতা রাস্তায় নামলো। উত্তাল হয়ে ওঠলো নেত্রকোনা। স্বাধীনতার পর এমন নেত্রকোনা আর দেখেনি কেউ। মিডিয়া কর্মীরাও সোচ্চার ভূমিকা রাখলো (অবশ্য দুয়েকটি পত্রিকা বাদে)। যাদবের বৃদ্ধ বাবাকে থানায় এনে বন্দি করে রেখেও কোনো স্বীকারোক্তি মিললো না। শেষ পর্যন্ত সরকারের বক্তব্য প্রত্যাহার করে নেয়া হলো। দু’দিন পর বলা হলোÑ ‘যাদব ওয়াজ এন ইননোসেন্ট বয়’!
( সূত্রঃ উদীচী ট্র্যাজিডির ৬ বছর,সঞ্জয় সরকার, দৈনিক আজকের পত্রিকা, শুক্রবার : ৯ ডিসেম্বর ২০১১ )
এদিকে তৎকালীন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী এই বোমা হামলার জন্য যাকে হিন্দু জঙ্গি বানিয়েছিলেন, সেই মোটর মেকানিক যাদব দাসের বৃদ্ধ পিতা সত্যেন দাস আর বৃদ্ধা মাতা আরতি দাস আবেগ তাড়িত কণ্ঠে বলেন, 'বোমা হামলায় আমাদের একমাত্র পুত্র যাদব নিহত হয়েছে। এই বোমা হামলার জন্য বাবর আমাদের যাদবকে দায়ী করছিল। আর সে সময় আমাদের উপর অত্যাচার নির্যাতন হইছে। রাইতের পর রাইত আমরা ঘুমাইতে পারি নাই। কিন্তু পরে আবার তারাই বলে যাদব নির্দোষ। এখন জঙ্গিদের ফাঁসি হইছে, হত্যাকারীর বিচার হইছে। কিন্তু আমরা যাদবের তো আর ফিরা পাইতাম না।'
(সূত্রঃ সকল হত্যাকাণ্ডের বিচার করেই জঙ্গিদের ফাঁসি কার্যকর করা উচিত ছিল,শ্যামলেন্দু পাল, মার্চ ৩১, ২০০৭, শনিবার )
এখনও মনে আছে বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদী দৈনিক আমার দেশ বিএনপি সরকারকে সমালোচনা করে ‘হিন্দু জঙ্গি’ যাদবকে নির্দোষ ঘোষণা করার জন্য। তাদের মতে হিন্দুদের ভোটের জন্যই বিএনপি সরকার হিন্দু জঙ্গিদের ধরছে না।
ঐ বোমা হামলায় ৯ জন নিহত ও কমপক্ষে ৫০ জন আহত হয়েছিল। ২০০৮ সালের ১৭ ফেব্রয়ারী ঢাকায় দ্রুত বিচার আদালত-২ এই বোমা হামলায় জড়িত থাকার অভিযোগে সালাউদ্দিন, আসাদুজ্জামান এবং ইউনূসকে মৃত্যুদণ্ড দিলেও আজ পর্যন্ত তা কার্যকর হয়নি। এদিকে জেএমবির আশ্রয়-প্রশ্রয়দাতাদের এখনো চিহ্নিত করতে পারেনি পুলিশ।
সাংবাদিক অজয় দাশগুপ্ত তার ‘সময়ের কথা-সকালের শতচ্ছিন্ন কাঁথায় বিকেলে জোড়াতালি’
প্রবন্ধে লিখেছিলেন, “২১ আগস্টের (২০০৪) ঘটনার পরপরই যদি বিএনপি-জামায়াতে ইসলামী নেতৃত্ব 'জজ মিয়া' উপাখ্যান তৈরির পরিবর্তে প্রকৃত অপরাধীদের খুঁজে বের করায় মনোযোগী হতো, তাহলে হয়তো ২০০৫ সালের ১৭ আগস্ট ৬৩ জেলায় একযোগে বোমা হামলা হতো না। পরের কয়েকটি মাস দেশের আরও কয়েকটি জেলাও আত্মঘাতী বোমাবাজদের হামলায় নরককুণ্ডে পরিণত হতো না। এ ধরনেরই একটি হামলা হয়েছিল নেত্রকোনা জেলায় ৮ ডিসেম্বর (২০০৫)। নিহতদের একজনের নাম যাদব দাস_ পেশায় মোটর মেকানিক। বাবর সাহেব মুহূর্ত দেরি না করে বললেন, 'যাদব দাসই আত্মঘাতী হামলাকারী। অতএব, নতুন ডাইমেনশন'। তার স্পষ্ট ইঙ্গিত :'একজন হিন্দু যেহেতু হামলা চালিয়েছে, তাই দেশব্যাপী ১৭ আগস্টের বোমা হামলা ও পরবর্তী আত্মঘাতী হামলার পেছনে আওয়ামী লীগ রয়েছে এবং কান টানলে যেমন মাথা আসে, তেমনই রয়েছে ভারত! প্রকৃতপক্ষে যাদব দাস নিহত হয়েছিল ঘটনাস্থল দিয়ে সাইকেল চালিয়ে যাওয়ার সময়। বিএনপি-জামায়াতে ইসলামী নেতৃত্ব যে শতচ্ছিন্ন কাঁথা নরম সুতা দিয়ে জোড়াতালি দিতে চেয়েছিল! এটা কি কেবলই গদি আঁকড়ে থাকার জন্য, নাকি বিরোধটা আদর্শেরও? ”
যাদব ভাই আমার মাফ করে দিও। মরেও তোমার সম্মান আমরা রক্ষা করতে পারি নাই। তোমাকে আরেক শৈবাল সাহা পার্থ বানানোর চেষ্টা করা হয়েছিল। তবে সচেতন মানুষ তা ব্যর্থ করে দেয়।
এ নিয়ে তখন ডেইলি স্টারের একটি লেখা পড়ুন
No comments:
Post a Comment