অন্ধকারাছন্ন, কুসংস্কারে আবৃত পরাধীন
ভারতবর্ষে মাত্র দু-বছরের-ও অল্প ব্যবধানে
জন্মগ্রহণ করেন শাশ্বত কালের এই দুই যাত্রী, দুই
অমৃত পুত্র, দুই বিশ্বপথিক, মানবপ্রেমী ও
প্রকৃতিপ্রেমিক দুই সত্তা, দুই সত্যসন্ধানী সাধক
বা বিজ্ঞানী| একজন যুবকবি, বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর; আর
আরেকজন, যুগাচার্য, বিশ্বজয়ী, বীর-সন্ন্যাসী, স্বামী বিবেকানন্দ| জন্ম
এক-ই সন্দিক্ষণে, এক-ই নগরী-তে, এক-ই সমাজ, তথা দেশে, শহরের
এ-পাড়ায়, ও-পাড়ায়|
ব্রাহ্মসমাজ-এর প্রবর্ত্তক মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের উজ্জ্বল রত্ন,
কনিষ্ঠপুত্র রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর অপরূপ রূপরাশি নিয়ে কলকাতায়
জোড়াসাঁকো ঠাকুর পরিবারে জন্মগ্রহণ করলেন ১৮৬১ সালের ৭ই মে|
অপরপক্ষে, কলকাতাতেই শিমুলিয়ায়ে (বর্তমানে শিমলা স্ট্রীটে)
অভিজাত দত্ত পরিবারে নামজাদা ব্যারিস্টার শ্রীবিশ্বনাথ দত্তের জ্যেষ্ঠপুত্র
অনিন্দদেহ, কান্তিময় নরেন্দ্রনাথ দত্ত: ১৮৬৩ সালের ১২-ই জানুয়ারী,
নবজীবনের স্ফুলিঙ্গ সঙ্গে নিয়ে পৃথিবীতে আবির্ভূত হলেন|
উভয়ের-ই বাল্যকাল ধর্ম ও সংস্কৃতি চর্চায় অতিবাহিত হওয়াতে দুজনেই
ভবিষ্যতে অসামান্যতার পরিচয় দিয়েছিলেন| শিক্ষা, দীক্ষা, সাহিত্য,
সঙ্গীত ও ধর্মচর্চায় উভয়ের পরিবার ছিল তখনকার সমাজে অগ্রণী|
রবীন্দ্রনাথ ক্রমে গায়ক, নাট্যকার, শিল্পী প্রভৃতিরূপে প্রকাশিত হতে
থাকলেন| অবশেষে নোবেল পুরস্কার লাভ করে বিশ্বকবি হিসেবে
সম্মানিত হলেন|
আরেকদিকে নরেন্দ্রনাথ দত্ত-ও বাল্যকাল থেকে নানা প্রতিভায় প্রস্ফুটিত
হতে থাকলেন| তখনকার দিনের অত্যন্ত নামকরা ওস্তাদদের কাছ থেকে
ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীত শিক্ষা ও নানা বাদ্যযন্ত্রের ব্যবহার বিধি শিখে
ক্রমে খ্যাতির শীর্ষে পৌঁছে যান।গায়ক ও বাদক হিসেবে বাল্যকাল
থেকেই স্কুল কলেজের সেরা ছাত্র ছিলেন; ডাকনাম বিরেশ্বর, মা
ভুবনেশ্বরী দেবী আদর করে ডাকতেন বিলে বলে| অত্যন্ত ধর্মপ্রান
মায়ের প্রকৃতি-ই বোধ হয় নরেন্দ্র কে বেশি প্রভাভিত করে ফেলেছিল|
পারমার্থিক বুদ্ধিচিন্তায় সর্বদা তাঁর মন চঞ্চল, অশান্ত হয়ে থাকত| ইশ্বর
কি কেউ
দেখেছেন? স্পর্শ করেছেন? তাঁর সঙ্গে কথা বলেছেন? এই সব প্রশ্নের
উত্তর তাঁর মনকে সর্বদা বহির্মুখ করে রাখত|
নরেন্দ্রনাথ দত্তের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মিলনের এক বিরল মুহূর্ত
ধরা পড়ল জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতেই| সহপাঠি বন্ধু দ্বিপেন্দ্রানাথ ঠাকুর
ওরফে 'দিপু' ছিলেন রবীন্দ্রনাথের ভাইপো| দিপেন্দ্র ও নরেন্দ্রের মধ্যে
বেশ হৃদ্যতা ছিল| নানা বিষয়ে আলোচনার পাশাপাশি সংগীতচর্চাও হত|
দুজনের অন্তরঙ্গতা থাকাতে দুজনেই দুজনের বাড়িতে আসা যাওয়া
করতেন|
নরেন একদিন দিপুর সঙ্গে তাঁদের বাড়িতে বসে যখন উদার কন্ঠে
ভারতীয় ধ্রুপদসংগীত পরিবেশন করছিলেন, তখন তাঁর গম্ভীর গম্ভীর
জোয়ারী কন্ঠের মূর্ছনা ধরা পড়ল মহাসঙ্গীত সাধক ও রচয়ীতা দিপুর
কাকা, রবীন্দ্রের অনুভবে| তিনি ওপরের ঘরে ছিলেন; সঙ্গে সঙ্গে নিচে
নেমে এলেন| অনিন্দ্যদেহ কান্তিময়, তেজঃদীপ্ত, উজ্জ্বল, উদ্ভাসিত নয়ন
ও সুধাময় কন্ঠে মোহিত হয়ে তাঁর সঙ্গে নিজেই পরিচয় করলেন এবং
সদ্য রচিত তিনখানি গান শিখিয়ে দিলেন| গানগুলি হলো:
(১) দুই হৃদয়ের নদী (রাগ শাহানা, তাল ঝাপতাল)
(২) জগতের পুরোহিত তুমি (রাগ খাম্বাজ, তাল একতাল)
(৩) শুভদিনে এসেছ দোহে (রাগ বেহাগ, তাল ত্রিতাল)
নিজে বসলেন অর্গান নিয়ে এবং নরেন বাজালেন পাখোয়াজ| সে
এক বিরল মুহূর্ত! দুই হৃদয়ের নদী একত্রে মিলিত| এক চায় একেরে
পাইতে, দুই চায় এক হইবারে| স্বয়ং স্রষ্টা রবীন্দ্রনাথের গানের অভূতপূর্ব
বৈচিত্র, তালে, ছন্দে আকৃষ্ট হয়ে পরেন নরেন্দ্র|
অসামান্য সুরজ্ঞান ও প্রখর স্মৃতিশক্তির জন্যে খুব অল্প দিনেই ঠাকুরবাড়ি
এবং ব্রাহ্মসমাজের, বিশেষতঃ মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের, দৃষ্টি আকর্ষণ
করেন| নরেন্দ্র, ওরফে, নরেনের মধ্যে যোগীর সকল লক্ষণ দেখে মহর্ষি
যেমন মুগ্ধ হন, তেমনি ঈশ্বর বিশ্বাসী এবং ধর্মপ্রান মহাত্মার সংস্পর্শে
এসে নরেনের মনের অস্থিরতা কিছুটা শান্ত হয়| মহর্ষি তাঁকে
ধ্যানাভ্যাসের কথা বলেন এবং পদ্ধতিও শিখিয়ে দেন ও ব্রাহ্মসমাজভুক্ত
করেন| মহর্ষি পুত্রবৎ নরেনকে স্নেহের বদলে সেদিন নিবেদন করলেন
শ্রদ্ধা ও আনুগত্য|
ধ্যানাভাসে অশান্ত নরেনের মন সামান্য শান্তি পেলেও, সম্পূর্ণতা পেল না|
অবশেষে ১৮৮১ সালের নভেম্বরে ঠাকুর শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ পরমাহংশের
সঙ্গে তাঁর দেখা হয় ব্রাহ্মসমাজেরই এক ভক্তের বাড়ীতে| উদীয়মান
গায়ক হিসেবে সেদিন আমন্ত্রিত হন নরেন্দ্রনাথ দত্ত| নরেন্দ্রের কন্ঠে
একের পর এক রবীন্দ্রসংগীত ও অন্যান্য সঙ্গীত শ্রবণ করে ঠাকুর
সমাধিস্থ হয়ে পরেন|
সমাধিভঙ্গ হলে নরেনের যাবতীয় শারিরীক ও মানসিক লক্ষণ দেখে
তাঁর প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পরেন এবং দক্ষিনেশ্বরে মা ভবতারিনীর মন্দিরে
যাবার জন্য সাদর আমন্ত্রণ জানান| শুরু হল যাতায়াত| নরেন ক্রমশঃ
এই যুগাবতার পরমহংসের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পরেন| তাঁর অশান্ত মনের
অবশিষ্ট যাবতীয় প্রশ্নের সমাধান পেয়ে পরম প্রীত হলেন এবং সমস্ত
দেহ, মন, প্রান নিবেদন করলেন শ্রীরামকৃষ্ণের চরণে| ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ
সস্নেহে তাঁকে গ্রহণ করলেন এবং সন্ন্যাস দীক্ষা দিলেন| নরেন্দ্রনাথ দত্ত
হলেন স্বামী বিবেকানন্দ|
অপরপক্ষে জীবনের অন্তিম পর্বে এসে যুগকবি রবীন্দ্রনাথ, যুগাবতার
শ্রীরামকৃষ্ণের সন্ন্যাস অর্থ উপলব্ধি করেছিলেন| তাঁর সন্ন্যাস সংসারের
সঙ্কোচন নয়, সংসারের প্রসারণ| ঘরের আঙ্গিনাকে বিশ্বের আঙ্গিনায়
নিয়ে যাওয়া| যুগাবতারের যত মত, তত পথ বাণী তাঁর বহু গল্প,
কবিতায় নানাভাবে পাওয়া যায়| জীবনের শেষ সায়াহ্নে লেখা
মালঞ্চ উপন্যাসের (১৯৩৩) শুরুতেই রয়েছে শ্রীরামকৃষ্ণের ছবি|
উপন্যাসে নীরজার চরিত্রের ভেতর দিয়ে নিজে প্রকাশিত হয়েছেন|
দুই মহাপুরুষ-ই সত্যকে জীবন থেকে জীবনে সঞ্চারিত করেছিলেন|
দুজনেরই সম্পর্কের আদিতে বেঁধেছিল সংগীত, অন্তে বিজ্ঞান| দু
জনের-ই চিন্তাধারায় বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি প্রধান হয়ে উঠেছিল|
হিন্দু-মুসলমান সমস্যা সম্পর্কে দুজনেই এক মতের ছিলেন| শিল্পকলা
, শিক্ষা, লোকসংস্কৃতি, নারী জাগরণ, সংগীত, রাষ্ট্রনীতি ইত্যাদি-তে ছিল
সমান আগ্রহ|
প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য গ্রন্থে স্বামীজি বলেছেন: অন্যায় কোরো না, অত্যাচার
কোরো না, যথাসাধ্য পরোপকার কোরো| কিন্তু অন্যায় সহ্য করা
পাপ|
নৈবেদ্য গ্রন্থে রবীন্দ্র-লেখনিতেও একই কথা:
অন্যায় যে করে আর অন্যায় যে সহে,
তব ঘৃনা তারে যেন তৃণসম দহে
মানবপ্রেমী এই দুই অমৃত পুত্রই বুঝতে পেরেছিলেন মানুষ-ই ভগবান|
বিবেকানন্দ বলেছিলেন, প্রত্যেক মানুষের মধ্যে ব্রহ্মের শক্তি বিদ্যমান|
দরিদ্রের মধ্যে দিয়ে নারায়ণ আমাদের সেবা পেতে চান| তিনি শুধু
সন্ন্যাসী নন, যেন এক চারণ কবি| স্বামীজির উক্তি: বহুরূপে সম্মুখে
তোমা ছাড়ি কোথা খুঁজিছ ঈশ্বর|
রবীন্দ্রকন্ঠে একই সুরের বাণী:
যেথায় থাকে সবার অধম, দীনের হতে দীন,
সেইখানে যে চরণ তোমার রাজে
সবার পিছে, সবার নীচে, সব হারাদের মাঝে
কবি রবীন্দ্রনাথের মধ্যে সন্ন্যাসীর ছায়া পরলেও আজীবন কবি-ই থেকে
গেছেন| প্রানের কান্না-হাঁসি গানের মধ্যে গেঁথে দিয়ে মানবজীবন ধন্য
করেছেন| আর সন্ন্যাসী বিবেকানন্দের চিত্তে কবির ছায়াপাত ঘটলেও,
তপস্যার আসন থেকে তিনি কখনো সরে আসেননি| একজন মূলত
সৌন্দর্যের পুজারী, অন্যজন তপস্বী সাধক|
রবীন্দ্রনাথ প্রতিষ্ঠা করেন বোলপুর ব্রহ্মচর্যাশ্রম শান্তিনিকেতনে|
বিবেকানন্দ করেন বেলুরমঠে| শান্তিনিকেতনের বিদ্যালয় তপোবন ও
ব্রহ্মচর্জাশ্রমের মিলন| অন্যদিকে, বেলুরমঠে হিন্দু ধর্মের ক্রিয়াকর্মের
সাধনপ্রণালী গ্রহণ করে বেদান্তের মতবাদের ওপর প্রথিষ্ঠিত| এই ম
ঠ হলো সর্বধর্মসমন্বয়ের কেন্দ্র; কর্মীরা সর্বত্যাগী সন্ন্যাসী|
দুজনেই মানুষের জয়গান গেয়েছিলেন দুভাবে| দুজনেই দুজনের শ্রদ্ধেয়
ছিলেন| স্বামীজির চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য সমূহ রবীন্দ্রনাথকে নানাভাবে
অনুপ্রানিত করেছিল| তাঁর নানা গল্প, কাব্য, উপন্যাসে তা একে একে
ধরা পড়েছে| তিনি জাপানি মনীষী ওকাকুরাকে বলেছিলেন:
if you want to know India, study Vivekananda. There is in
him, everything positive, nothing negative. অপর পক্ষে
বিবেকানন্দ বলেছিলেন, ভারতবর্ষ-কে জানতে হলে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের
কাছে যান| তিনি জীবনের মধ্যে আছেন| আমার তো এখানে সর্বস্ব ত্যাগ|
রামকৃষ্ণের তীরধানের পর পরিব্রাজক স্বামীজি ভারতবর্ষের ঐতিহ্যের
আদর্শ তুলে ধরতে দেশে বিদেশে ঝড়ের বেগে ছুটে বেরিয়েছেন|
আমেরিকায় পেয়েছিলেন এক নতুন অভিধা: the Cyclonic Hindu
Monk. রবীন্দ্র পৌঁছেছিলেন গ্রামে গঞ্জে, চাষীদের ম্লান মুখে হাঁসি
ফোটানোর জন্যে| কৃষিব্যাঙ্ক, ট্রাক্টর, মন্ডলীপ্রথা ইত্যাদি নিয়ে শুরু
করেন কর্মযজ্ঞ| এদিকে সারা পৃথিবী স্বামীজির প্রেরনায় তখন
তোলপাড়| নিজের ভেতরের অদম্য শক্তিকে জাগ্রত করতে
যুবসম্প্রদায়ের ভেতর তুফান বয়ে নিয়ে বেরিয়েছেন আশা,
আলো আর শান্তির বাণী|
দুই অমৃতকন্ঠে যেন একই মন্ত্রধ্বনি:
বিশ্বাধাতার যজ্ঞশালা আত্মহোমের বহ্নিজ্বালা
জীবন যেন দিই আহুতি মুক্তি আসে
সমান্তরাল পথের দুই যাত্রীর ছিল স্বতন্ত্র জীবনধারা| মাত্র ৩৯
বছর বয়েসে স্বামীজি দেহ রাখেন| তিরধনের সাতদিন পর
কলকাতায় উপস্থিথ রবীন্দ্রনাথ বিবেকানন্দের স্মরণ সভায়
সভাপতিত্ত্ব করেন| ১২ই জুলাই, ১৯০২ সালে কলকাতার
ভবানীপুরের সাউথ সুবার্বান স্কুলে অনুষ্ঠিত বিবেকানন্দ
শোকসভায় কবি সভাপতির ভাষণে স্বামীজির কর্মজীবন ও
বাণীর তাৎপর্য ব্যাখ্যা করে গভীর শ্রদ্ধার অর্হ্য নিবেদন করেন|
- দেবযানী মজুমদার।
বিঃ দ্রঃ: উল্লেখ্য যে, এই রচনাটি লেখার জন্য প্রয়োজনীয় তথ্য এবং
কিছু সঙ্কলন করার প্রয়োজনে যে সব গ্রন্থের সাহায্য গ্রহণ করা হয়েছে,
সেই সব গ্রন্থের লেখকদের নাম সশ্রদ্ধ চিত্তে স্মরণ করি| শ্রী অমিতাভ
চৌধুরী, শ্রী শঙ্করী প্রসাদ বসু, শ্রী বিমল কুমার ঘোষ এবং শ্রী পার্থসারথি
চট্টোপাধ্যায়| এ ছাড়াও, পশ্চিম বঙ্গ সরকারের প্রকাশিত
রবীন্দ্ররচনাবলী-ও সহায়ক গ্রন্থ হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে|
এই লেখাটি প্রথম প্রকাশিত হয় ২০১১ সালে দক্ষিন ক্যালিফর্নিয়ার
স্যান দিয়েগো-র বঙ্গ সমিতি সৈকত-এর পত্রিকা কবি প্রনাম-এ।
পরবর্তী কালে, এটি পুনঃপ্রকাশিত হয় রবিনন্দন-এর ২০১২ সালের বার্ষিক পত্রিকায়।
No comments:
Post a Comment